• শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪২৯

শিল্প

পোশাক শিল্প নিয়ে ভুল তথ্য যাচ্ছে বিদেশে

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ২৪ মার্চ ২০২৪

অর্থনীতি ডেস্ক:

ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনকারী পোশাকশ্রমিক যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার, তাদের মুক্তি এবং হয়রানি বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ব্যবসায়ীদের সংগঠন আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন (এএএফএ)। তবে তাদের আহ্বান ভুল তথ্যের উপর নির্ভর বলে মনে করেন পোশাকখাত সংশ্লিষ্টরা। কারণ, সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে কোনও আটকের ঘটনা চলমান নেই এবং গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় অভিযুক্ত শ্রমিক নেতা বাবুল আক্তার জামিনে মুক্ত।

এএএফএ’র চিঠিতে সংগঠনটির সভাপতি স্টিফেন লামার বলেছেন, ‘আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের পক্ষ থেকে আমি আবারও ২০২৩ সালে ন্যূনতম মজুরির দাবিতে বিক্ষোভ ঘিরে হাজার হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে চলমান আটক ও আটকের হুমকি বন্ধের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। পাশাপাশি আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিক্ষোভের সময় সহিংসতায় প্রাণহানি ও শ্রমিক আহত হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করছি।’

চিঠিতে স্টিফেন ল্যামার লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাকের তৃতীয় বৃহৎ সরবরাহকারী বাংলাদেশ। তা ছাড়া বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে জুতা ও ভ্রমণে ব্যবহৃত পণ্য সরবরাহও দ্রুত বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিরাট গুরুত্ব রয়েছে।’ তিনি বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করছেন। তিনি বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে সুবিধাজনক সম্পর্ক উভয়ের জন্য সমৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এসেছে।’

এএএফএর চিঠিতে বলা হয়, গভীর উদ্বেগের সঙ্গে শ্রমিকদের বিষয়ে তাদের আবারও আহ্বান জানাতে হচ্ছে। ন্যূনতম মজুরি নিয়ে বিক্ষোভের সময় গ্রেপ্তার সব ব্যক্তিকে মুক্তি প্রদান, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনা সব ফৌজদারি অভিযোগ প্রত্যাহার এবং আরও হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেপ্তারের হুমকি বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া গত বছর গ্রেপ্তার হওয়া জুয়েল মিয়ার মতো যেসব শ্রমিক সংগঠকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় এএএফএ।

দেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পে প্রতি পাঁচ বছর পরপর নতুন মজুরিকাঠামো ঘোষিত হয়। গত বছর ন্যুনতম মজুরি পুনরায় নির্ধারণের সময়কালে হঠাৎ করেই শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হয় গাজিপুর-আশুলিয়া এলাকায়। মজুরি নির্ধারণের পর থেমে যায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন। আন্দোলনের সময় গাড়ি পোড়ানো হয়, অনেক কারখানা ভাংচুর করা হয়। আগের মজুরি ৫৬ শতাংশ বাড়িয়ে নতুন মজুরি নির্ধারণ করে সরকার। আন্দোলনে কারখানা ভাংচুর করা হলেও আন্দোলনকারী শ্রমিকদের পূর্ণ বেতন দিয়ে আবারো কাজে ফিরিয়ে নেয় কারখানা মালিকরা। আন্দোলন চলাকালে কিছু শ্রমিক নেতার ইন্ধনে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা কারখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় হামলা চালায়। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে শ্রমিক নেতা বাবুল আক্তার ছিল, তার বিরুদ্ধে আন্দোলনচলাকালীন সময়ে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন।

চিঠিতে ন্যুনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন করার কারনে শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে – এমন তথ্য ভুল। মুলত আন্দোলনের নামে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করার প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেয় পুলিশ। শ্রমিক সংগঠনের কিছু নেতৃবৃন্দ ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
এর আগেও কয়েকজন শ্রমিক নেতৃবৃন্দদের বিরুদ্ধে ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১৪ সালে জুন মাসে জুন মাসে ভালুকায় পাইওনিয়ার গার্মেন্টসের কয়েক মাইল দূরে শ্রমিকদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘাত হয়। এ ঘটনায় গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ কোনোভাবে জড়িত ছিলো না। তারপরও বিজিএমইএ, শ্রম মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাউকে অবহিত না করে এ ঘটনা প্রসঙ্গে ওয়াশিংটনে চিঠি দেয় কিছু শ্রমিক নেতা। শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের অভিযোগ, বিদেশ থেকে ফান্ডিং এনে সংগঠন চালানোর জন্য কিছু শ্রমিক নেতা মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে। একই অভিযোগ ছিল বাবুল আক্তারের বিরুদ্ধেও।

সেই প্রসঙ্গে একজন শ্রমিক নেতা জানান, শ্রমিক সংগঠন চলবে নিজেদের টাকায়, তা না হয়ে যদি তা বিদেশি অর্থপুষ্ট হয় তাহলে এমনই ঘটবে। কারণ বিদেশিরা তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই টাকা দেয়। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে তা মালিক ও সরকার পক্ষ থেকে অনেক আগেই বলা হয়েছে।

পোশাক শিল্প নিয়ে অনেকদিন ধরেই চলছে ষড়যন্ত্র। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেশের পোশাক শিল্প নিয়ে বিভিন্ন সময়ে চালান হয়েছে নানা অপপ্রচার। এমনকি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৈরি পোশাকখাতে মার্কিন স্যাংশন নিয়ে অপপ্রচার চালান হয়েছে।

এই চিঠির আগে তৈরি পোশাক খাত নিয়ে চিঠি দিয়েছিল মার্কিন ৮ কংগ্রেসম্যান। পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে বেতন-ভাতা সমন্বয় করার পরও সংশোধিত বিষয়টি নিয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ করেছেন মার্কিন কংগ্রেসম্যানরা। তারা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য চিঠি দেয় আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যারকে (এএএফএ)। তবে কংগ্রেসম্যানদের চিঠির আগেই বিজিএমইএ তাদেরকে চিঠি দিয়ে বেতন সমন্বয়ের তথ্য জানান।

শ্রমিকদের যাপিত জীবন নিয়ে সম্প্রতি ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে একটি বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে ফ্রিল্যান্সার লেখক তাসলিমা দাবি করেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে নারী পোশাক শ্রমিকরা সন্তান ও নিজের জীবন বাঁচাতে যৌনকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন। এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে শ্রমিক সংগঠনগুলো। দেশের কয়েকটি পত্রিকা সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করলেও বিভ্রান্তিকর বিবেচনায় পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনের পর বিক্ষোভ করে প্রতিবাদ জানায় শ্রমিক সংগঠনগুলো। সেসময় সম্মিলিত শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শ্রমিক নেতা নাহিদুল হাসান নয়ন বলেন, ‘কিছু মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের দেশের পোশাক খাত এবং নারী শ্রমিকদের নামে গুজব ছড়িয়ে বিশ্বের দরবারে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’-এর সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যে শ্রমিকদের শ্রমের ঘামে ঘোরে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা, যে নারী শ্রমিকদের বলা হয় গোল্ডেন গার্ল সেই নারী শ্রমিকদের হেয় প্রতিপন্ন করে যৌনকর্মী হিসেবে আখ্যায়িত করে নারী-নীতি, মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা ও আইএলও কনভেনশন-১৯০ লংঘন করেছে।’

গণমাধ্যমে এমন প্রতিবেদনের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিজেএমইএ। সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান জানান, এরকম একটা সংবাদ আমাদের জন্য সত্যিই বিব্রতকর। এটি ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, বাস্তবতা বিবর্জিত ও মনগড়া ।

তিনি বলেন, ‘এই নিউজের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। এ ধরণের নিউজ করে এই সেক্টরে যেসব মেয়েরা কাজ করছে তাদেরকে আসলে নিচু করা হয়েছে, অপমান করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের নারীদের অসমান করা হয়েছে।’

বাংলাদেশ ন্যাশনাল লেবার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মরিয়ম আক্তার বলেন, ‘বর্তমান সরকারের শ্রমবান্ধব প্রধানমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে চলতি বছরের ৮ নভেম্বর শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা নির্ধারন করেন যা ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। মজুরি বাস্তবায়নের এই সময়েই দুটি গণমাধ্যম গার্মেন্টস শ্রমিক ও নারী শ্রমিকদের নিয়ে বানোয়াট ও অপমানজনক সংবাদ প্রকাশ করে। আমরা উক্ত সংবাদের তীব্র নিন্দা জানিয়ে উক্ত প্রত্যাখান করছি।’

শ্রমিকদের নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ায় নিজেদের কোন্দলের মাধ্যমেও। শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন। তিনি বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি ও পাওনা বেতন আদায় করে দিতে কাজ করতেন। এই শ্রমিক নেতা হত্যার পর দেশে বিদেশে সমালচনার ঝড় বয়ে যায়। মুলত গাজীপুরে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার অভিযোগ তদন্ত করে মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ। সেখানে বলা হয়েছে, শ্রমিকদের বেতনভাতার সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে আসামিদের হাতে নিহত হন শহিদুল। মামলার অন্যান্য আসামিরা কেউ শ্রমিক নেতা কেউ স্থানীয় বাসিন্দা।

হত্যা মামলার তদন্ত কমিটির প্রধান ও গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইমরান আহম্মেদ জানিয়েছেন,একজনের এলাকায় আরেকজনের প্রবেশ নিয়ে শ্রমিক সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে স্থানীয় কয়েকজনের ইন্ধনেই শ্রমিক নেতা শহিদুলকে হত্যা করা হয়েছে। এরইমধ্যে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের ইশারায় অন্য আসামিরা শহিদুলের ওপর হামলা চালায়। তদন্ত ও যাচাই-বাছাই শেষে অভিযোগপত্রটি অনলাইনে আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। মামলায় যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা সবাই শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।

দ্য আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন (এএএফএ) হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় এনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিজিএমইএকে চিঠি দিয়েছিল গত বছর।

এর আগে ২০১২ সালে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড আলোচিত হয়েছিল দেশে বিদেশে। তিনি শহিদুলের সংগঠনেরই নেতা ছিলেন। সরকার এই হত্যাকান্ডের বিচার নিশ্চিত করেছে। আমিনুল ইসলাম হত্যাকান্ডে একজনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত।

/আসিফ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads